সত্য বলতে দ্বিধা ও লজ্জা !!
বাসে উঠে একটা খালি সিট পেলাম। জানালার পাশে আমি বসলাম, আর পাশের সিটটা খালি! একটু পরেই একটা সুন্দরী মেয়ে উঠলো। বোরকা পড়া, মাথায় হিজাব দেয়া। মেয়েটাকে এক নজর দেখলেই বোঝা যায় খুবই ভদ্র ও অবস্থা সম্পন্ন ঘরের মেয়ে। এদিক ওদিক সিট খুজে না পেয়ে শেষে আমার পাশে এসে বসলো। হাতে একটা মোবাইল। দেখে বোঝা যায় অনেক দামী একটা মোবাইল।
কিছুদূর যাবার পর বাস আবার জ্যামে পড়লো। মেয়েটা বলে উঠলো, অসহ্য জ্যাম! আমিও হুম বলে সম্মতি জানালাম। এরপর টুকটাক কথা হতে লাগলো। বাসও চলতে শুরু করলো......!
কথায় কথায় জানলাম, মেয়েটি ইংরেজিতে অনার্স করছে। খুবই ফ্রী ভাবে কথা বলছিলাম আমরা! ওয়ারলেছ গেটের ওখানে গিয়ে আবারও জ্যামে পড়লো বাস। বিরক্তিকর জ্যাম!
জ্যামের মধ্যেই বাসে উঠলো শার্ট পড়া কালো চেহারার মধ্যে বয়সী একটা লোক। অনেক দিনের পুরনো বোধহয় শার্ট টা! ময়লা হয়ে আছে। তার হাতে অনেক গুলো নামাজ শিক্ষা বই। কাধে কালো রঙের একটা ব্যাগ। লোকটা নামাজ শিক্ষা বই বিক্রি করছে! লোকটা অনেক্ষণ যাবত, বইতে কী কী গুরুত্বপূর্ণ দোয়া, সূরা, মাসয়ালা ইত্যাদি আছে তা বর্ননা করলো। কিন্তু বাসের কেউ একটা বইও কিনলো না!
আমার খুব খারাপ লাগলো। ইচ্ছে করছিল লোকটাকে কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করি! কিন্তু, লোকটাকে টাকা দিতে চাইলে যদি কিছু মনে করে। তাই দিলাম না!
একটা জিনিষ লক্ষ্য করলাম,লোকটা বাসে ওঠার পর থেকে মেয়েটি আমার সাথে একটা কথাও বলেনি। মাথা নিচু করে মোবাইল টিঁপতেছে! বাড়িতে নামাজ শিক্ষা বই থাকা সত্বেও শুধু মাত্র লোকটিকে সাহায্য করার ইচ্ছায় বিশ টাকা দিয়ে দুইটা বই কিনলাম। লোকটিকে পঞ্চাশ টাকার নোট দিলে সে ত্রিশ টাকা ফেরত দিল!
টাকা ফেরত দেবার পরেও দেখি সে পকেট থেকে আরও টাকা বের করছে! একটা একশ টাকার নোট আর কয়েকটা দশ টাকার নোট! আমার দিকে এগিয়ে ধরলো! আমি তো অবাক। আমাকে টাকা দেবেন কেন উনি?
আমার ভুল ভাঙলো তার ডাক শুনে! তিনি আমাকে না মেয়েটিকে টাকা দিচ্ছেন! তিনি বললেন, ‘সোমা টাকাটা রাখো।কিছু কিনে খেয়ে নিও! তোমার মা বললো, তুমি সকালে না খেয়েই ভার্সিটিতে চলে আসছো‘। মেয়েটি লজ্জায় মরে যাচ্ছিল। সে অত্যন্ত রেগে লোকটার দিকে তাকালো! বললো, "লাগবে না!"
লোকটি জোর করে টাকাটা তার হাতে দিয়ে বাস থেকে নেমে গেল!
মেয়েটার দিকে তাকানো যাচ্ছিল না! রেগে টং হয়ে আছে! আমি কৌতুহল সামলাতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, 'যে আপনাকে টাকা দিল উনি কে?' মেয়েটা বললো, আমাদের বাড়ির পাশে থাকে!
আমি বললাম, কিছু মনে করবেন না। একটা কথা বলি, উনি কি আপনার বাবা? মেয়েটি রেগে তাকালো আমার দিকে! জবাব দিলো না! এমন ভাব করলো যেন আমি মহা অপরাধ করে ফেলেছি!
আমি বুঝতে পারলাম তার রাগের কারন। তার বাবা একজন ভ্রাম্যমাণ হকার। বাসে বাসে ঘুরে বই বিক্রি করে। আর সে দামী পোশাক পড়ে ভার্সিটিতে যায়! সে একজন শিক্ষিত মানুষ! এজন্য সে বাবার পরিচয় দিতে লজ্জা পায়! এই ময়লা শার্ট পড়া লোকটাকে বাবা বলে স্বীকার করাটাকে সে ঘৃণার চোখে দেখে! সে চায় না দুনিয়ার কেউ জানুক, এই হকার লোকটা তার বাবা! কত বড় বিবেক সম্পন্ন মানুষ সে!
যে লোকটা রাত দিন পরিশ্রম করে বাসে বাসে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বই বিক্রি করে মেয়েটাকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলছে। তাকে লেখাপড়া শেখাচ্ছে। নিজে কয়েক বছরের পুরনো একটা শার্ট পড়ে অথচ মেয়েটিকে দামীপোশাক, ব্যাগ, দামী মোবাইল কিনে দিয়ে তার সমস্ত চাওয়া পূরন করেছেন। সেই মানুষটাকে বাবা বলে পরিচয় দিতে লজ্জা করছে মেয়েটির! কত বড় নির্লজ্জ!
যে মানুষটা তাকে লালন পালন করে এত বড় করলো, যারটা খেয়ে বেঁচে আছে তাকে বাবা বলে পরিচয় দিতে সমস্যা! মেয়েটি হয়তো শিক্ষিত হচ্ছে, কিন্তু তার ভেতরে বিবেক ও মানুষত্ব তৈরি হয়নি! হকার লোকটির প্রতি শ্রদ্ধায় মনটা ভরে উঠলো! লোকটা হাজার কষ্টের মাঝেও পরম মমতায় নিজের মেয়েটিকে উচ্চশিক্ষিত করে তুলছেন!
আদর্শ বাবা মনে হয় একেই বলে। অন্য কেউ হলে হয়তো অনেক আগেই মেয়েটিকে কোন শ্রমিকের সাথে বিয়ে দিয়ে দিত। সেটাই বোধহয় ভাল হত! তাহলে তখন হয়তো মেয়েটি বাবার পরিচয় অস্বীকার করতো না!
যেই শিক্ষা আমারদের মধ্যে বিবেক ও মনুষ্বত্ব তৈরী করেনা, কী লাভ সেই শিক্ষা গ্রহণ করে? শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় নয়, আমরা আমাদের সন্তানদের নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলব ইনশাআল্লাহ্! (সংকলিত)
(www.blogkori.tk)
(www.blogkori.tk)
No comments:
Post a Comment