'মা' এর তুলনা শুধুই মা
“মায়ের একধার দুধের দাম, কাটিয়া গায়ের চাম, পাপস বানাইলে ঋনের শোধ হবে না, আমার মা মাগো”
দিনক্ষন ঠিক করে কি মাকে ভালবাসা যায় ? মায়ের প্রতি সন্তানের ভালবাসা চির বহমান, চলমান নদীর স্রোতের মতো।মায়ের ভালবাসার কোন বিনিময় মূল্য নেই। ‘বিশ্ব মা দিবস’ পালন করার রীতি যে ব্যবসায়িক সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই দিবস পালনের পেছনে অধিকাংশই ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য কাজ করে । আমি কোন দিবস পালনে বিশ্বাস করি না । বছরের ৩৬৫ দিনই তো আমার মায়ের জন্য। পৃথিবীর প্রতিটি মা’ই মমতাময়ী ‘মা’। মায়ের মমতাকে পৃথিবীর কোন কিছুর সাথে তুলনা করা চলে না। মায়ের তুলনা একমাত্র মা।মায়ের চেয়ে আপন কে আছে এই পৃথিবীতে ? মায়ের চেয়ে বড় কে আছে ? সৃষ্টিকর্তার পর মা-ই হচ্ছেন মানুষের সবচেয়ে বড় স্নেহের আশ্রয়স্থল। সন্তানের হৃদয়ের শান্তি-স্বস্তি সবই এনে দিতে পারেন একজন মাত্র মানুষ, তিনি মা।
লেখক,নাট্যকার ইমদাদুল হক লিখেছেন, প্রত্যেক মানুষেরই দুই মা। এক মা গর্ভে ধারণ করেন, আরেক মা দেশমাতৃকা। এক মা অবলীলাক্রমে তাঁর বুক খালি করেন আরেক মায়ের জন্য। দেশের মুক্তির জন্য, দেশের স্বাধীনতার জন্য এক মায়ের কাছ থেকে আরেক মা উদ্ধারে ছোটেন সন্তান।
‘একবার বিদায় দে মা, ঘুরে আসি’।
দেশমাতৃকাকে রবীন্দ্রনাথ বলেন
‘ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফেরে’।
মায়ের চেয়ে বহুল উচ্চারিত শব্দ আর নেই। জন্মের পর, চোখ খোলার পর যে মানুষটিকে প্রথম দেখে শিশু, সেই মানুষটি মা। পৃথিবীর যেকোনো দেশে যেকোনো ভাষায় শিশু প্রথম উচ্চারণ করে ‘ম’ শব্দটি। ‘ম’ থেকে মা। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস তাঁর বিখ্যাত ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’ গ্রন্থে ‘মা’ শব্দের ব্যাখ্যা করেছেন ‘সকল জাতির ভাষার আনুকৃত’।মা-হারা এক গ্রাম্য কিশোরী গভীর জ্যোৎস্না রাতে মায়ের জন্য কাঁদে আর গায়,
”মাগো তোমার মতো নেয় না কেহ আমায় বুকে টানি
আঁচল দিয়া মোছায় না কেউ আমার চোখের পানি
হায়রে মা জননী আমার, হায়রে মা জননী।’
‘
মাকে নিয়ে আনিসুল হক উপন্যাস লিখেছেন। উপন্যাসের নাম ‘মা’। আজাদ ছিলেন এক দুর্দান্ত মুক্তিযোদ্ধা। ঢাকায় গেরিলা অপারেশনের প্রস্তুতি নিতে গিয়ে ধরা পড়লেন পাকিস্তানিদের হাতে। রমনা থানায় তাঁকে রাখা হলো। খবর পেয়ে মা এলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। এসে বললেন, ‘শক্ত হয়ে থেকো বাবা। সহযোদ্ধাদের নাম বোলো না।’ আজাদ বললেন, ‘না মা, বলব না। তুমি কাল যখন আসবে, আমার জন্য ভাত নিয়ে এসো। কত দিন ভাত খাই না।’
পরদিন ছেলের জন্য ভাত নিয়ে গেছেন মা। গিয়ে দেখেন, ছেলে নেই। নেই তো নেই-ই। ছেলেকে আর ফিরে পাননি মা। তারপর ১৪ বছর বেঁচে ছিলেন আজাদের মা। কিন্তু একটি দিনের জন্যও ভাত মুখে দেননি। তাঁর ছেলে ভাত খেতে চেয়েছিল, ছেলের মুখে ভাত তুলে দিতে পারেননি, তিনি সেই ভাত কেমন করে খান!
এই হচ্ছেন আমাদের মা। বাংলার মা।
কোন লেখনী বা কলমের কালি দিয়ে মায়ের প্রতি ভালবাসা আর শ্রদ্ধাকে কি পরিমাপ করা সম্ভব? কোনোভাবেই না। আমার পৃথিবীজুড়ে শুধুই একজন। সে তো আমার মা। সন্তান জন্ম দিতে মাকে কতটুকু কষ্ট সহ্য করতে হয় সেটা একমাত্র মা’ই জানে। মানুষের ব্যথা পরিমাপ করার জন্য বিজ্ঞান যন্ত্র আবিষ্কার করেছে। আধুনিক বিজ্ঞানই বলে, মানুষ সর্বোচ্চ ৪৫ ডেল (ব্যথা পরিমাপের একক) ব্যথা সহ্য করতে পারে। কিন্তু একজন মা যখন সন্তান জন্ম দেন তখন তিনি ৫৭ ডেল ব্যথা সহ্য করেন; যা একই সময়ে ২০টি হাড় ভেঙে ফেলার সমান। সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাতে কতটুকু কষ্ট মাকে করতে হয় তা আমরা সন্তানরা বুঝব কী করে!কোন সন্তানই মায়ের প্রসব ব্যথার যন্ত্রনা বুঝতে পারে না। যদি বুঝতে পারত তবে কোন সন্তানই তার মাকে পরিবার থেকে বিচ্ছন্ন করে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতেন না।
প্রাণিজগতের অন্য যেসব প্রাণী আছে, তাদের সন্তানরা পৃথিবীতে আসার পর হাঁটতে জানে, দৌড়াতে জানে, উড়তে জানে কিংবা সাঁতার কাটতে জানে। কিন্তু একমাত্র মানুষ, শুধু মানুষই ব্যতিক্রম। তারা না পারে হাঁটতে, দৌড়াতে, না পারে উড়তে আর না পারে সাঁতার কাটতে। ক্ষুধায় চটপট করলেও মানবসন্তান কখনোই পারে না নিজের খাবারটা চেয়ে খেতে। কিন্তু মায়ের হৃদয় কীভাবে যেন তা জেনে যায়। সন্তান দুরে থাকলেও সন্তানের বিপদের খবর মা সবার আগে জানে।
এমন মাকেও যারা কষ্ট দেন তারা সত্যিই মানুষ কি-না আমার প্রশ্ন জাগে। স্ত্রীর প্ররোচনায় হোক কিংবা অন্য যে কোনো কারণেই হোক, মাকে অনেকেই কষ্ট দিয়ে থাকেন। হাল আমলে ঝামেলা মনে করে অনেকে বাবা-মাকে রেখে আসেন বৃদ্ধাশ্রমে। কিন্তু যারা এ কাজ করেন কখনও কি ভেবে দেখেছেন_ তারাও একদিন বৃদ্ধ হবেন, তারাও মা-বাবা হবেন? তাদের নিয়তিতেও যে এমন কিছু লেখা নেই, তার নিশ্চয়তা কি? মা তো মা-ই। সন্তানের এমন আচরণও তারা কীভাবে যেন পরম মমতায় ক্ষমা করে দিতে পারেন! ভাবতে পারি না আল্লাহ তাদের হৃদয়ে কী এমন স্নেহের সমুদ্র সৃষ্টি করে দিয়েছেন!
যাদের মা আজ বেঁচে নেই, তারা পৃথিবীর সবচেয়ে অমূল্য সম্পদটিই হারিয়েছেন। জন্মান্তরের বাঁধন ছিঁড়ে মা আজ স্রষ্টার সানি্নধ্যে। পৃথিবীর সবাই ভালোবাসার প্রতিদান চাই এমনকি নিজের স্ত্রীও। কিন্তু একমাত্র মা, মায়েরাই পারেন কোনো প্রতিদানের আশা না করেই সন্তানকে ভালোবাসতে। মায়ের অভাব আপনিই হয়তো বুঝতে পারবেন অনেক বেশি যখন মাকে হারাবেন। যদিও যান্ত্রিক আর ব্যস্ত এ পৃথিবীতে অনেকের অবশ্য সে বোধ এখন আর নেই। যখন দেশে ছিলাম, মায়ের কাছাকাছি ছিলাম, মায়ের সানিধ্যে ছিলাম তখন মাকে অনুভব করতাম না, এখন প্রবাস জীবনে যতটুকু করি। আমার মতো সকল প্রবাসীর এমন হয় কিনা জানিনা।মায়ের শূন্যতা পৃথিবীর কোন কিছু দিয়ে পূরন করা যায় না। মায়ের শূণ্য স্থান একমাত্র মায়ের আদর সোহাগ দিয়ে পূরন করা সম্ভব। আমি এখন পিতা তাই আমি এখন অনুভব করতে পারি সন্তানের প্রতি মায়ের আকুলতা।
একজন মায়ের কাছে পৃথিবীর সকল সন্তানই তার আপনার সন্তান। অনেক ভুল, অনেক অপরাধ জেনে হোক বা না জেনে হোক, হয়তো করে ফেলে সন্তানেরা। আমরা জানি, মা, দয়ার সাগর। সন্তান যখন মায়ের সামনে অপরাধ স্বীকার করে দাঁড়ায়, তখন সকল মায়ের হৃদয়ই নরম হয়! আপন মহিমায় মা সকলকে ক্ষমা করেন। তাই আজ স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা, ‘হে আল্লাহ, ছোট্টবেলায় মা-বাবা আমাদের যেভাবে লালনপালন করেছেন, তুমিও ঠিক সেভাবে তাদের লালনপালন করো।
(সংগৃহীত)
No comments:
Post a Comment